বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১০ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
আমরা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন এবং টাকা পয়সা দেনা পাওনার নিমিত্তে একে অপরকে ব্যাংক চেক দিয়ে থাকি। পরবর্তীতে সেই চেকের বিপরীতে টাকা না থাকলে চেক প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়। এ মামলাটি কেন, কখন, কিভাবে দায়ের করতে হবে, এ মামলা দায়েরের স্থানসমূহ, সঠিক নিয়ম-কানুন কি, তা নিয়ে আইনী আলোচনা জানুন।
কোথায় মামলা দায়ের করা যাবে। সহজ উত্তর, ৭টি স্থান থেকে এ মামলাটি দায়ের করা যাবে। মামলা দায়েরের স্থান সম্পর্কে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ ৫৯ ডিএলআর, ২৩৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, ১) যে স্থানে চেকটি হস্তান্তর হয়েছে অর্থাৎ চেকটি ড্র করা হয়েছে, সে স্থানীয় অধিক্ষেত্রের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চেক ডিসঅনার মামলা করতে পারবেন, ২) যে ব্যাংক থেকে চেকটি ফেরত এসেছে, সে অধিক্ষেত্রে, ৩) যেখানে চেক গ্রহীতা বসবাস করে, ৪) যে স্থানে চেকদাতা বসবাস করে, ৫) যে স্থান থেকে চেক ডিসঅনার সংক্রান্ত নোটিশ প্রদান করা হয়েছে, ৬) যে স্থান থেকে চেক হস্তান্তকারী নোটিশের জবাব দিয়েছেন, ৭) যে স্থানের ব্যাংকে চেকটি নগদায়নের জন্য উপস্থাপিত করা হয়েছে-এরকম সাতটি স্থানের অধিক্ষেত্রে মামলা করা যাবে।
শুরুতেই জেনে নিই কী কী কারণে চেক ডিস্অনার হয়। অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে, চেকের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে, চেক প্রদানকারীর স্বাক্ষরের মিল না থাকলে, টাকার পরিমাণ অংকে এবং কথায় মিল না থাকলে, চেক প্রদানকারী এ্যাকাউন্ট ক্লোজ করলে, স্টপ পেমেন্ট করলে, ভবিষ্যত তারিখ লেখা থাকলে যাকে পোষ্ট ডেইটেড চেক বলে, রেফার টু ড্রয়ার ইত্যাদি ১০ থেকে ১২ টি কারণে চেক ডিসঅনার হতে পারে। অনেকে জানতে চান, চেক ডিসঅনার কয়বার করাতে হয়। উত্তরটা হল একবার ডিসঅনার করালেই করা যায়। এখন জানার বিষয় চেকটি ডিসঅনার হলে কি করবেন। সহজ উত্তর, এ জানানোর কাজটি আপনি নিজেও করতে পারেন।
চেক ইস্যুকারীর হাতে নোটিসটি সরাসরি পৌঁছে দিয়ে রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করিয়ে নিন। দ্বিতীয়ত, প্রাপ্তি স্বীকার রসিদসহ (এডি) রেজিস্টার্ড ডাকযোগে বাংলাদেশে তার জ্ঞাত ঠিকানায় নোটিস প্রেরণ করতে পারেন। অথবা আপনার কোন মনোনীত আইনজীবীর মাধ্যমে নোটিশ দিতে পারেন অথবা বহুল প্রচারিত কোন জাতীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকাতেও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেন। তবে এ কাজটি করতে হবে চেক ডিসঅনার হওয়ার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে। আর নোটিস প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেক ইস্যুকারী যদি চেকের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হন তবেই নেগোসিয়েবল ইন্ট্রমেন্ট এ্যাক্ট, যাকে সংক্ষেপে এন.আই এ্যাক্ট এবং বাংলায় হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারার আওতায় তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। আর এই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। কোনো কারণে যদি প্রথমবার চেকটি ডিজঅনার হওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে নোটিস পাঠানো সম্ভব না হয়, তাহলে দ্বিতীয়বার চেকটি পরিশোধের জন্য ব্যাংকে উপস্থাপন করতে পারেন।
এভাবে একাধিকবার চেকটি ব্যাংকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, চেকটি ইস্যুর তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে নগদায়নের জন্য উপস্থাপন না করলে চেকটি কার্যকারিতা হারায়। আর চেকদাতা যদি কোনো কোম্পানি হয় এবং ওই কোম্পানি যদি সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই অপরাধ সংঘটনের সময় কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী হবেন এবং আইন অনুযায়ী দ-িত হবেন। কোম্পানির ক্ষেত্রে এনআই এ্যাক্টের ক্ষেত্রে ১৩৮ ধারার পাশাপাশি ১৪০ ধারা উল্লেখ করে মামলা করতে হয়। আর কোন কারনে আইনের নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে প্রতারনার জন্যও চেকদাতার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। মামলাটি করতে হয় আমলী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
মামলা করার সময় আদালতে মূল চেক, চেক ডিজঅনার কপি, লিগ্যাল নোটিস অথবা পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির কপি অথবা পোস্টাল রসিদ ও প্রাপ্তি স্বীকার রসিদের ফটোকপি ফিরিস্তি আকারে মামলার আবেদনের সঙ্গে দাখিল করতে হবে। এই ব্যাংক চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদ পর্যন্ত কারাদ- অথবা চেকে উল্লিখিত অর্থের সর্বোচ্চ তিন গুণ পরিমাণ অর্থদ- অথবা উভয় প্রকার দ-ের এ আইনে আছে। তবে দ-ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। চেকে উল্লিখিত টাকার কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ যে আদালত দ- প্রদান করেছেন, সে আদালতে জমা দিয়ে আপিল করতে হবে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮